শিশুদের ডায়াবেটিস: সময়মতো চিনে নেওয়া আর যত্নই উপায় মাত্র ছয় বছর বয়সে মৌসুমির (ছদ্মনাম) আচমকা শরীর খারাপ হতে শুরু করল। হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড প...
শিশুদের ডায়াবেটিস: সময়মতো চিনে নেওয়া আর যত্নই
উপায়
মাত্র ছয় বছর বয়সে মৌসুমির (ছদ্মনাম) আচমকা শরীর খারাপ হতে শুরু করল। হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড পিপাসা, রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব, দুর্বলতা—প্রথমে এসব উপসর্গকে সাধারণ শরীর খারাপ হিসেবেই ধরেছিলেন মা–বাবা। কিন্তু একদিন খুব খারাপ অবস্থা হল—মৌসুমি শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছে, কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পর ধরা পড়ল, রক্তে তার গ্লুকোজের মাত্রা ৩০ মিলিমোলেরও বেশি। চিকিৎসকেরা জানালেন, এটি ‘ডায়াবেটিক কিটো অ্যাসিডোসিস’—একটি গুরুতর অবস্থা, যা সাধারণত টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
টাইপ–১ ডায়াবেটিস: কী এবং কেন
ডায়াবেটিস আসলে একাধিক রূপে দেখা দেয়, যার একটি হলো টাইপ–১ ডায়াবেটিস। এটি মূলত শৈশব বা কৈশোরে ধরা পড়ে এবং একটি অটোইমিউন সমস্যা—যেখানে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভুল করে নিজের ইনসুলিন উৎপাদনকারী বিটা কোষের বিরুদ্ধে কাজ করে। ধীরে ধীরে বিটা কোষ ধ্বংস হয়ে যায় এবং অগ্ন্যাশয় আর ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজ বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে শরীরে দেখা দেয় ডায়াবেটিক কিটো অ্যাসিডোসিস, যা প্রাণঘাতীও হতে পারে।
এই ধরনের ডায়াবেটিসের একমাত্র চিকিৎসা ইনসুলিন। তাই একে আগে বলা হতো ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস। বর্তমানে এর পরিচিতি টাইপ–১ ডায়াবেটিস হিসেবে। একবার রোগ ধরা পড়লে রোগীকে সারা জীবন ইনসুলিন নিতে হয়।
লক্ষণ: কখন সতর্ক হবেন
টাইপ–১ ডায়াবেটিস সাধারণত হঠাৎ করেই প্রকাশ পায়। ধীরে ধীরে বাড়ে না, বরং কয়েক দিনের মধ্যেই শিশুর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়। সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে:
- অতিরিক্ত প্রস্রাব
- রাতের বিছানা ভেজানো
- অসময়ে ক্ষুধা ও পিপাসা বেড়ে যাওয়া
- ওজন কমে যাওয়া
- চোখে ঝাপসা দেখা
- দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট এবং অবচেতন হয়ে যাওয়া
এসব লক্ষণ দেখা দিলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো জরুরি। চিকিৎসকেরা সাধারণত লক্ষণ দেখেই টাইপ–১ ডায়াবেটিস শনাক্ত করতে পারেন, কারণ ইনসুলিন ছাড়া রক্তের শর্করা কমানো সম্ভব হয় না। যাঁরা নিশ্চিত হতে চান, তাঁদের জন্য ইনসুলিন বা সি–পেপটাইডের মাত্রা ও কিছু অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যেতে পারে।
এ রোগ কেন হয়?
এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা না গেলেও গবেষকেরা মনে করেন, জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং কিছু বিশেষ ভাইরাস সংক্রমণ টাইপ–১ ডায়াবেটিসের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। যেমন: কক্সস্যাকি, রুবেলা বা সাইটোমেগালো ভাইরাস। পশ্চিমা দেশ, বিশেষত স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে এই ডায়াবেটিসের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও শনাক্তকরণ হার বাড়ছে—প্রতি এক লাখ শিশুর মধ্যে বছরে গড়ে ৪.২ জন টাইপ–১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে বলে তথ্য রয়েছে।
চিকিৎসা ও বর্তমান অগ্রগতি
টাইপ–১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ইনসুলিনই একমাত্র ভরসা। এক সময় ইনসুলিন না থাকায় এ রোগ মানেই ছিল মৃত্যু। ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কারের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ইতিহাসে প্রথম ইনসুলিন প্রয়োগ করা হয় ১৪ বছরের এক শিশুর ওপর, যে ইনসুলিন নেওয়ার পর আরও ১৪ বছর বেঁচেছিল।
বর্তমানে চিকিৎসার অনেক উন্নতি হয়েছে। আধুনিক ইনসুলিন, ইনসুলিন পেন, এমনকি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তিনির্ভর ইনসুলিন পাম্প ব্যবহৃত হচ্ছে, যা রক্তের গ্লুকোজমাত্রা বুঝে প্রয়োজন মতো ইনসুলিন সরবরাহ করতে পারে।
বাংলাদেশে সুবিধা কোথায় মিলবে?
বাংলাদেশে টাইপ–১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত শিশুদের জন্য রয়েছে বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র। বারডেম হাসপাতালের সেগুনবাগিচা শাখায় চালু আছে সিডিআইসি প্রকল্প, যেখানে বিনা মূল্যে ইনসুলিন, প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বিএসএমএমইউ, ও অন্যান্য মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারি হাসপাতালেও রয়েছে ডায়াবেটিস চিকিৎসা সুবিধা।
শেষ কথা
শিশুদের টাইপ–১ ডায়াবেটিস ভয় পাওয়ার মতো কিছু নয়, তবে এটিকে চেনা এবং যত্ন নেওয়া জরুরি। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে এই শিশুরাই বড় হয়ে স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারে। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা, নিয়মিত ইনসুলিন ও জীবনধারা ব্যবস্থাপনা।
সবার আগে পেতে Follow করুন:
" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"