Page Nav

HIDE

Breaking News:

latest

হুমায়ুন ফরীদি ভাই আমাদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

  ১৯৭৯ সাল। আমি তখন কুমিল্লা ছেড়ে সদ্য ঢাকায় এসেছি চারুকলায় পড়তে। সেবারই ঢাকা থিয়েটারের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পরিচয় হলো হুমায়ুন ফরীদি ভাই ও...

 

হুমায়ুন ফরীদি ভাই আমাদের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

১৯৭৯ সাল। আমি তখন কুমিল্লা ছেড়ে সদ্য ঢাকায় এসেছি চারুকলায় পড়তে। সেবারই ঢাকা থিয়েটারের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পরিচয় হলো হুমায়ুন ফরীদি ভাই ও সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে। তখনো জানতাম না, এই মানুষদের সঙ্গে ভবিষ্যতে এতটা পথ একসঙ্গে হাঁটবো।


এর কয়েক বছর পর, ১৯৮৫ সালে, ফরীদি ভাই বড় এক সিদ্ধান্ত নিলেন—চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি অভিনয়ের জন্য উৎসর্গ করলেন। কিন্তু জীবনটা তখনও খুব অনুগ্রহশীল ছিল না। শুধু অভিনয় করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠছিল। বাধ্য হয়ে ব্যবসার দিকে ঝুঁকলেন। বন্ধুবান্ধব অনেকে তখন বিজ্ঞাপন নিয়ে কাজ করছিলেন, তিনিও সেই জগতে পা রাখলেন।


পরের বছর, ১৯৮৬। ধানমন্ডির ১৯ নম্বর সড়কের এক ছয়তলা বাড়ির ছাদে দুটি ছোট ঘর নিয়ে উঠলেন তিনি। নিচু ছাদ, ছাদে আগুনের মতো গরম, একটা মাত্র টেবিল ফ্যান, একটা টেবিল। ওটাই ছিল বাসা আর অফিস—নাম ‘জোডিয়াক’। আমরা তিনজন—ফরীদি ভাই, সুবর্ণা আর আমি—সেখানেই থাকতাম।


একবার রপ্তানি মেলায় মুন্নু সিরামিকের প্যাভিলিয়নের দায়িত্ব পান ফরীদি ভাই। তখন মেলা হতো সংসদ ভবনের পাশেই। সেই গরম ঘরেই আমি ডিজাইন করলাম শোকার্ড, পোস্টার আর অন্যান্য প্রদর্শনসামগ্রী।


ফরীদি ভাই তখন নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত, টিভি নাটকে কাজ করেন, মাঝে মাঝে শর্টফিল্মে অভিনয়। কিন্তু অদ্ভুত এক হতাশা ঘিরে রাখে—অনেক প্রজেক্ট মাঝপথেই থেমে যেত।


তখন কাকরাইলের ফরিদপুর ম্যানশন ছিল সিনেমা সংশ্লিষ্ট মানুষদের জমায়েতস্থল। সেখানেই ছিল ফরীদি ভাইয়ের বন্ধু আহসান ভাইয়ের অফিস। দুপুরবেলা তিনি সেখানে বসতেন, পরিচালকরা আসতেন, দু-একটা কথা হতো। কিন্তু নাটকের লোককে তখনো সিনেমার জন্য অযোগ্য বলেই ভাবতেন অনেকে।


সেখান থেকে কখনো বিটিভিতে রেকর্ডিং থাকলে আমাকে বলে যেতেন—‘তুই পরে চলে আসিস।’ আমি আমার কাজ শেষ করে রাতে বিটিভিতে যেতাম। রেকর্ডিং শেষে একসঙ্গে বাড়ি ফিরতাম।


একবার এমনই এক রাতে, বিটিভির গাড়িতে আমরা অনেকেই ফিরছিলাম—আমি, ফরীদি ভাই, সুবর্ণা। ঠিক তখন নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর গাড়িতে যাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে গাড়ি থামিয়ে বললেন, ‘তোমরা আমার গাড়িতে এসো, আমি বাসায় নামিয়ে দেব—কথা আছে।’


শুধু নাটক নয়, জীবনের গল্পগুলোও নাট্যরচনার মতোই—তফাৎ শুধু, সেখানে কোনো রিহার্সাল নেই।


সেই রাতে আমরা তিনজন—আমি, ফরীদি ভাই আর সুবর্ণা—গাড়িতে উঠেছিলাম আবদুল্লাহ আল-মামুন ভাইয়ের সঙ্গে। আমি সামনের সিটে, পেছনে ফরীদি ভাই আর সুবর্ণা। গাড়ি চলছিল শান্তিনগরের দিকে, মামুন ভাই ফিরছিলেন বেইলি রোডে।


চুপচাপ চলছিল গাড়ি। হঠাৎ মামুন ভাই বললেন,

"শোনো ফরীদি, আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক উপন্যাসটা নিয়ে সিনেমা করব। ভিখু চরিত্রটা আমি নিজেই করব। তুমি করবা অমুক চরিত্রটা।"


ফরীদি ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,

"আমি ছাড়া ভিখু কেউ করতে পারবে না, মামুন ভাই।"


এরপর মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে মামুন ভাই ড্রাইভারকে বললেন,

"গাড়ি থামাও।"


গাড়ি থামল শান্তিনগর মোড়ে। তিনি নেমে পেছনের দরজাটা খুলে দিয়ে বললেন,

"নামো তোমরা।"


আমরা নামলাম। রাত তখন একটা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি তিনজন—একদম বোকার মতো। মামুন ভাই গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন বেইলি রোডের দিকে। অনেক কষ্টে একটা রিকশা পেলাম, ধানমন্ডির বাসায় ফিরলাম।


সেই রাতের কথা আমরা আর কখনো আলোচনা করিনি। মামুন ভাইও প্রায় সাত-আট মাস ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।


তারপর একদিন রাতে আমরা বাসায় খাচ্ছি। ফরীদি ভাই বললেন,

"একটা খবর আছে। আজ মামুন ভাইয়ের সঙ্গে বিটিভিতে দেখা। বললেন, ‘আমি শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক করব। আমি রমজান করব, তুমি লেকু।’ আমি বললাম, 'আমি ছাড়া রমজান কেউ করতে পারবে না, মামুন ভাই। আপনি লেকু করেন।' মামুন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমিই রমজান করবা, ফরীদি। তুমি ছাড়া রমজান কেউ পারবে না।'"


ফরীদি ভাই তখন অভিনয় নিয়ে অসম্ভব সিরিয়াস। প্রায় রাতেই বাসায় ফিরে জ্যাক নিকলসনের সিনেমা দেখতেন। শুধু মূকাভিনয়ের ওপর বই পড়তেন। নৃত্য ও লোকনৃত্যের ওপর প্রচুর বই সংগ্রহ করতেন, পড়তেন। কখনো সারা রাত পদ্মা নদীর মাঝি শ্রুতিনাট্য শুনতেন ক্যাসেটে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিল তাঁর নেশার মতো। আরেকটা প্রিয় বই ছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা।


একবার তাঁর বাবা এলেন বাসায়, থাকতেন ফতুল্লায়। খেতে বসে হেসে বললেন,

"জানো মাসুক, ফরীদি যে আয়না সিরিজের সেরাজ তালুকদার করে, ওটা তো আমার বাবার মতো! যেভাবে চলাফেরা করত, যেভাবে বলত—হুবহু!"

ফরীদি ভাইও বিনা দ্বিধায় বললেন,

"ঠিক ধরেছেন, আমি দাদার কপি করেছি।"


আরেকটা ঘটনা আজও ভুলতে পারি না। একদিন বাসায় ফিরছি। ধানমন্ডি ১৯ নম্বরের সামনে একটা চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। দোকানের মালিক হঠাৎ একটা বাচ্চা কুকুরের ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দিল। কুকুরটা চিত্কার করতে করতে ছুটে গেল, আমাদের চোখের সামনেই ঘটল ঘটনাটা।


সেই রাতে আর কিছুই হয়নি আমাদের। শুধু ওই কুকুরের বাচ্চাটার সঙ্গে কাটল পুরোটা রাত। একটা ফার্মেসি থেকে প্রাণিচিকিৎসকের নম্বর জোগাড় করলাম। ডাক্তার এলেন, ওষুধ দিলেন। কিন্তু বাচ্চা কুকুরটা সারা রাত ব্যথায় ছটফট করছিল। ফরীদি ভাই তার পাশেই বসে থাকলেন, এক মুহূর্তের জন্যও সরে যাননি।


এই মানুষটা বাইরের দুনিয়ায় যতটা তীব্র, ভেতরে ঠিক ততটাই কোমল।






সবার আগে পেতে Follow করুন:

" আঁধার আলো নিউজ গুগল নিউজ"

" আঁধার আলো নিউজ টুইটার "

" আঁধার আলো নিউজ ফেসবুক

"আঁধার আলো নিউজ পিন্টারেস্ট ;

" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"

" আঁধার আলো নিউজ লিংকডইন "