নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণায় বিলম্বের জন্য বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতার অভাবকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতার...
নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণায় বিলম্বের জন্য বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে সমঝোতার অভাবকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ঠিকানা’র এক টকশোতে মন্তব্য করেছেন সাবেক জামায়াত নেতা ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইসলাম।
তিনি দাবি করেন, বিএনপি এবং তাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি দল গোপনে নির্বাচনী সমঝোতার আলোচনায় যুক্ত রয়েছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বিএনপির সঙ্গে পর্দার অন্তরালে সিট ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করেছে। যদিও মঞ্জুরুল ইসলামের এ বক্তব্যের বিরোধিতা করে জামায়াত ও এনসিপি নেতারা বিষয়টিকে ভিত্তিহীন বলেছেন।
মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, “রাজনীতির বাইরেও একটা রাজনীতি কাজ করে। বিএনপি নির্বাচনের প্রতি আগ্রহী, কারণ তারা জানে, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সম্ভব। যেসব দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভালো করতে পারবে না বলে মনে করে, তারাই নির্বাচন পেছাতে চায়।
তিনি আরও বলেন, “এনসিপি গোপনে বিএনপির সঙ্গে ৫০ থেকে ৭০টি আসন নিয়ে আলোচনা করেছে। যদি হঠাৎ করে এই সমঝোতা চূড়ান্ত হয়, তাহলে দেখবেন সেপ্টেম্বরেই সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হয়ে যাবে। জামায়াতও একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি। তারা সরাসরি নির্বাচন চায় না, কিন্তু যদি বিএনপি ৫০টি আসন ছাড়ে, তাহলে তারা অক্টোবরে নির্বাচন মেনে নেবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে সরাসরি মন্তব্য না এলেও দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামছুজ্জামান দুদু বলেন, “আমরা রোডম্যাপ ঘোষণার পক্ষে। সেটাই এখন আমাদের অগ্রাধিকার। রোডম্যাপ ঘোষণার পর আসন ভাগাভাগির আলোচনা হতে পারে।
নির্বাচন নিয়ে চলমান আলোচনা ও বিতর্কে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনও পরিপক্ক পর্যায়ে পৌঁছায়নি বলে মন্তব্য করেছেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইসলাম। তবে এই দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এনসিপি। দলটির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক খান মোহাম্মদ মুরসালিন স্পষ্ট করে বলেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের কোনো আসন সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি জানান, এনসিপি বর্তমানে সংগঠন গঠনের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সারা দেশে দলীয় কার্যক্রম জোরদার করছে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে মুরসালিন বলেন, প্রথমে তারা একটি ঘোষণাপত্র চান, যা জুলাই মাসে প্রকাশিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এরপর নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পাশাপাশি বিচার ও সংস্কার নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, এই সংস্কারগুলো যেন পরে বাতিল না হয়, তা নিশ্চিত করতে একটি গণপরিষদ গঠনের প্রয়োজন রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরের এক নেতা, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবস্থায়, মন্তব্য করেন, কিছু ব্যক্তির বক্তব্য রাজনৈতিক হীনমন্যতা থেকে আসছে। তিনি বলেন, “যে দলের নেতৃত্বে কেউ আছেন, তার কাছ থেকে আরও পরিণত বক্তব্য প্রত্যাশিত।”
এদিকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মনিরুল ইসলাম মিলন বলেন, ২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলকে বাইরে রেখে জাতীয় পার্টিকে জোর করে নির্বাচনে রেখেছে। এমনকি সাবেক চেয়ারম্যান এরশাদ ও বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। তার মতে, বর্তমানে আওয়ামী লীগ যেভাবে নির্বাচনী পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটি আবারও এক ধরনের ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করছে।
তিনি আরও বলেন, “আসন ভাগাভাগির গুজব চলছে, কিন্তু জাতীয় পার্টি কখনো আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায়নি। বিরোধী দল হওয়া আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। আমাদের জোর করে নির্বাচনে ঠেলে বিরোধী দল বানানো হয়েছে।”
মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, “দলভিত্তিক আসন ভাগাভাগির রাজনীতি নয়, প্রয়োজন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, যেখানে জনগণই নির্ধারণ করবে কারা সংসদে যাবে। ষড়যন্ত্র করে জাতীয় পার্টিকে বাইরে রেখে যদি ‘বানরের রুটি ভাগ’ ধরনের নির্বাচন হয়, তাহলে তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, যেমনটি হয়নি আগের নির্বাচনগুলো।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, এনসিপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দলটিকে সংকটে ফেলেছে। তাদের শক্তিশালী প্রার্থীর অভাব রয়েছে, তাই তারা বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিতদের ব্যবহার করে বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে পারে। তবে তিনি মনে করেন, বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে আসবে এবং বড় জয় পাবে, এ কারণেই কিছু দল নির্বাচনের আগে সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধী দলের পরিচয় নিতে চায়।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আসন ভাগাভাগির সমঝোতা সংক্রান্ত বক্তব্য ভিত্তিহীন। তিনি জানান, জামায়াত ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন ও রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে এবং নির্বাচন-সংক্রান্ত সংস্কারগুলোকে বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দায়িত্ব দিচ্ছে।
তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনাসহ দুর্নীতিগ্রস্তদের বিচারের পাশাপাশি সংবিধান ও বিচার বিভাগের সংস্কার অপরিহার্য। এই বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে অনেকাংশে ঐকমত্য রয়েছে। ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ১৩৩টিতে আমরা একমত।”
জুবায়ের আরও বলেন, সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য তিনটি পন্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে—গণভোট, গণপরিষদ ভোট এবং পার্লামেন্টে সরাসরি ভোট। জামায়াত চায় গণভোটের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হোক, এনসিপি চায় গণপরিষদের মাধ্যমে পাস হোক এবং বিএনপি চায় নির্বাচিত সংসদেই এই প্রস্তাব পাস করানো হোক।
সংস্কার নিয়ে মতবিরোধের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুটি মূল বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে:
- 1. পরপর দুইবারের বেশি একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এতে জামায়াত ও এনসিপি একমত হলেও বিএনপি গ্যাপ দিয়ে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ রাখার পক্ষে।
- 2. নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে—জামায়াতের সংখ্যানুপাতিক ভোট পদ্ধতি প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত নয়।
তাছাড়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের ক্ষেত্রেও পৃথক মত রয়েছে। জামায়াত চায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে কাউন্সিল গঠন হোক, যেখানে বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে।
শেষে এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, মতপার্থক্যই রাজনীতির সৌন্দর্য। এটি বিরোধিতা নয়। জুলাই বিপ্লবে যারা আত্মত্যাগ করেছে, তাদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। শিগগিরই নির্বাচন নিয়ে একটি সমাধান আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সবার আগে পেতে Follow করুন:
" আঁধার আলো নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে"